হাসিনার সরকার পতনে যেভাবে ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষার্থীরা

Published : 21:51, 15 July 2025
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা দেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। আন্দোলনটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার পর তারা দেখতে পেল যে, পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ১৫ জুলাই যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন, তখনই সারা দেশের ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে।
তাদের কণ্ঠে ছিল বিদ্রোহের স্লোগান-
‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!’
‘কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’
শুরুতে, এই স্লোগানের সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত অনেক শিক্ষার্থী দ্বিমত পোষণ করলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মূল যে দাবি ছিল কোটা সংস্কারের, তা সবাই সমর্থন করেছিল এবং তাদের কাছেও এই সংস্কারের দাবি ছিল যৌক্তিক।
ওই দিন থেকেই সরকার পুলিশ বাহিনী এবং ছাত্রলীগের মাধ্যমে নিরীহ ছাত্রদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সমন্বয়কদের সঙ্গে ঐকমত্যে এসে সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
দেশব্যাপী আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন রংপুরের আবু সাঈদ। এরপর মুগ্ধসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী শহীদ হন। প্রথম দিনেই সারা দেশে ছয়জন এবং পরদিন এই সংখ্যা বেড়ে ৩৪ জনে পৌঁছায়। সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে, আবু সাঈদের মৃত্যুর মর্মান্তিক ভিডিওটি অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরাও এই ভিডিও দেখে নিজেদের আবেগকে আর ধরে রাখতে পারেনি। তাদের হৃদয়ে গভীর বেদনা ও ক্ষোভ জমে ওঠে এবং তারাও এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে শুরু করে।
আবেগ, বেদনা এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা একত্রে মিশে গিয়ে বিদেশে বসেও শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের একটি অঙ্গ হয়ে ওঠে। তারা হয়তো সরাসরি রাজপথে থাকতে পারেনি কিন্তু তাদের সমর্থন, প্রার্থনা এবং প্রতিবাদ ছিল ঠিক ততটাই শক্তিশালী; যা এই সংগ্রামকে বিশ্বব্যাপী একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।
১. কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বিবৃতি
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিটি ইউনিভার্সিটি থেকে আলাদা আলাদা স্টেটমেন্ট দিতে শুরু করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। এছাড়াও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ছাত্রদের প্রতি জুলুম এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা তীব্র নিন্দা জানায়। আমার জানামতে মোট ১১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- এমআইটি, হার্ভার্ড, পারডু বিশ্ববিদ্যালয়, ভার্জিনিয়া টেক, টেক্সাস এ অ্যান্ড এমসহ বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়।
২. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবাদ সমাবেশ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়; যেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের পোস্টার নিয়ে প্রতিটি ইউনিভার্সিটি বা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন এবং সরকারের জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
পোস্টারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু স্লোগান-
• ‘Stop Killing Students’.
• ‘Reform Quota’.
• ‘We Want Justice’.
• ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’।
• ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’।
• ‘বুকের মাঝে ভীষণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’।
এই স্লোগানগুলো শিক্ষার্থীদের দাবি এবং আন্দোলনের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে এবং সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
৩. ওয়াশিংটন ডিসি, ফ্লোরিডা ও নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি, ফ্লোরিডা ও নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারের মাঝেও উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর হয়ে ওঠে এবং পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে।
তারা জানতে চায়- বিদেশে কোন কোন শিক্ষার্থী এই আন্দোলন করছে এবং তাদের পরিচয় সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করে। মূলত, বিদেশি শিক্ষার্থীদের কিছুটা ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রবাসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা এই ভয়কে তোয়াক্কা না করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মুনা হাফসা আপু ও নজরুল ইসলাম সোহান ভাইসহ নাম না জানা অনেকেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় (বাল্টিমোর ও কলেজ পার্ক), জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে এ প্রতিবাদে অংশ নেয়।
এছাড়াও নিউইয়র্কের বাংলাদেশ দূতাবাসেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানায়। তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চান- ‘কেন শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে, কেন তাদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে, কেন তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে না এবং কেন সরকারের ভুলগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে’। তবে দূতাবাসের কর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। বরঞ্চ তারা সরকারের পক্ষে তোষামোদি করে বেড়িয়েছে।
৪. টাইমস স্কয়ারে সমাবেশ
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশির বসবাস নিউইয়র্কে। আর টাইমস স্কয়ার হলো সেই নিউইয়র্কের প্রাণ; যা বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলনস্থল। বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সেই টাইমস স্কয়ারেও বিশাল এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশিরা দেশে চলমান পরিস্থিত বিশ্বের নজরে আনার চেষ্টা করে। রাতের বেলায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশি ছাত্র-জনতা এই সমাবেশে অংশ নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। কয়েক হাজার মানুষের এই আন্দোলন সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক জোরাল প্রতিবাদ হিসেবে উঠে আসে।
৫. ব্ল্যাকআউট, অস্থিরতা ও আন্দোলন প্রত্যাহারের গুজব
১৮ জুলাই যখন সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ঘোষণা করে, তখন বিদেশে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীরা এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। তারা না পারছিল নিজেদের পরিবারের সদস্যদের খবর নিতে, না পারছিল দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো আপডেট পেতে বা দিতে। এই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। কয়েকজন সমন্বয়ককে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়; যা আসলে পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তোলে। বিদেশে বসেও সবাই এক বাক্যে বলে উঠে, এইটা সরকারের সেই পুরোনো ষড়যন্ত্র। কেউই তা বিশ্বাস করেনি।
এরকম পরিস্থিতিতে আমার আশপাশে যত বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের দেখেছি- তারা কেউই তাদের গবেষণা কাজ বা নিয়মিত কাজে মনোযোগ দিতে পারছিল না। সবাই খুব অস্থির সময় পার করছিলাম এবং ভীষণ উৎকণ্ঠায় ছিলাম যে, দেশে আসলে কী ঘটছে। আমাদের মধ্যে একটাই চিন্তা ছিল—দেশের মানুষরা কি নিরাপদে আছে, নাকি তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে? এ উদ্বেগের কারণে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজের প্রতি কোনো মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
এরকম ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সময়, যখন আমরা দেশের কোনো খবরাখবর কোনোভাবেই পাচ্ছিলাম না এবং সব ধরনের টিভি চ্যানেল বন্ধ ছিল, তখন কিছু অনলাইন পেজ আমাদের নিয়মিত দেশের আপডেট দিচ্ছিল। আমি জানি না তারা কীভাবে এই আপডেটগুলো সংগ্রহ করেছিল, তবে তারা আমাদের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
৬. আন্দোলন নিয়ে গান ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন
বিদেশে অবস্থান করলেও দেশের আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারার একটা আক্ষেপ আমাদের সবার মাঝেই ছিল। তবুও আমরা কোনো না কোনোভাবে নিজেদেরকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছি। এ উদ্দেশ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে এসে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন এবং আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করেছিল।
তারা সেই একাত্তরের সময়ের মধুর গানগুলোকে পুনরায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন; যা আমাদের মনকে আন্দোলনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছিল। এই ছোট্ট উদ্যোগগুলো আমাদের মনে এমন একটি অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল; যা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন। এটি আমাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যের সঞ্চার করেছিল; যা আমাদের সবাইকে আন্দোলনের সঙ্গে আবেগকেও সম্পৃক্ত করেছিল।
৭. বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স গ্রুপের অবদান
যুক্তরাষ্ট্রে সবমিলিয়ে ২০ হাজার বা তারও বেশি বাংলাদেশি গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট রয়েছেন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা বিএসএ বা বিএসও রয়েছে। তবে এরা কখনোই একটি কমন প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়নি। এ আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো- বিভিন্ন বিএসএ এবং বিএসও-কে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হয়েছে বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে (যারা উদ্যোগ নিয়েছেন তারা হলেন- মো. আনোয়ার হোসেন, আহমেদ ইলদিরিম ত্বকি, মো. ইমতিয়াজ কামরুলসহ আরও অনেকেই)। পাশাপাশি, স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলা হয়েছে (যারা উদ্যোগ নিয়েছেন তারা হলেন- আব্দুল্লাহ আল আমিন লিমন, মো. সুমন আলী ভাই, এবং আমার বন্ধু মো. মাহমুদুল ইসলামসহ আরও অনেকেই); যা এই সংহতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এই দুটি প্ল্যাটফর্মের মূলত দুটি প্রধান কাজ দেখতে পেয়েছি। প্রথমত, একটি হলো যৌথ টুইটার ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা। আপনারা জানেন যে, আওয়ামী লীগ তাদের সিআরআইয়র (সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন) মাধ্যমে টুইটারে স্টুডেন্টদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছিল। সেই প্রচারণার মোকাবিলার জন্য এই যৌথ টুইটার ক্যাম্পেইন চালু করা হয়েছিল। এতে বিভিন্ন নিউজ, আপডেট এবং আন্দোলনের তথ্য শেয়ার করা হতো; যা স্টুডেন্টদের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করেছিল।
অন্যদিকে, স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স গ্রুপটি বিভিন্ন ধরনের ইমেইল ড্রাফটিং করেছিল। এই ইমেইলগুলো বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠানো হয়েছিল, যাতে তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতে পারে। তারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল- বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সব ধরনের ভিডিও সংগ্রহ করে সেগুলোকে সংরক্ষণ করেছে, যাতে পরবর্তীতে কোনো ডকুমেন্টারি তৈরির সময় সেগুলো কাজে লাগানো যায়।
এছাড়াও যেসব বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বাইরে থেকে এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছিলেন, তাদের সবাইকে একত্রিত করে একটি অনলাইন মিটিংয়ের আয়োজন করে; যাতে প্রত্যেকে দেশের পরিস্থিতি এবং বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের করণীয় নিয়ে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়।
৮. কংগ্রেস ম্যান ও সিনেটরদের ইমেইল
এখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কংগ্রেসম্যান, সিনেটর, স্টেট অফিসিয়াল এবং বিভিন্ন নিউজ মিডিয়াকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিস্তারিত জানিয়ে ইমেইল করেছে। প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সংবলিত একটি চিঠি প্রস্তুত করা হয়; যা প্রায় সব সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যানদের কাছে পাঠানো হয়। এই চিঠির মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের চলমান আন্দোলন এবং সরকারের দমন-পীড়নের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে।
এই প্রচেষ্টার ফলে অনেক সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যান টুইটারসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে আহ্বান জানায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য।
৯. রেমিট্যান্স শাটডাউন ক্যাম্পেইন
প্রবাসীরা যখন সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিতে পারছিল না, তখন তারা বুঝতে পারল যে, তাদের হাতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। সেটি হলো- রেমিট্যান্স। স্বৈরাচার সরকার রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে এত বছর ধরে টিকে আছে। প্রবাসীরা উপলব্ধি করল যে, রেমিট্যান্স অব্যাহত রাখার জন্য সরকারকে তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই চাপে পড়েই সরকার চারদিন পর ইন্টারনেট সচল করতে বাধ্য হয় এবং বিভিন্ন ছোট ছোট পর্যায়ে ব্যাংকগুলো চালু রাখতে শুরু করে।
আন্দোলনে এতগুলো সাধারণ ছাত্রছাত্রী শহীদ হওয়ার দৃশ্য দেখে প্রবাসীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, যতদিন পর্যন্ত এই স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের দাবিগুলো মেনে না নেবে, ততদিন পর্যন্ত তারা কোনো ধরনের রেমিট্যান্স আর পাঠাবে না। ছাত্ররাও নিজেদের রেমিট্যান্স পাঠানো থেকে বিরত রেখে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।
রেমিট্যান্স শাটডাউনের অংশ হিসেবে দেখেছি- কেউ কেউ তাদের নিজ ক্যাম্পাসে একটি লিস্ট তৈরি করছিলেন; যাতে তারা শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগে হযোগিতা করতে পারেন। তারা রেমিট্যান্স বন্ধ করার ব্যাপারে অধিকাংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছিলেন। এছাড়া রেমিট্যান্স শাটডাউন নিয়ে প্রচুর অনলাইন ক্যাম্পেইনও চালানো হয়েছিল। এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই- পলক সংবাদ সম্মেলনে হাতজোড় করে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুরোধ করে সবাইকে।
১০. হাসিনাকে উৎখাতে লুইসভিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বিবৃতি
এই কথা বললে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কিনা জানি না, তবে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি ছাত্ররা তুলেছিল ৩ আগস্ট, কিন্তু তারও প্রায় দুই সপ্তাহ আগে, অর্থাৎ ২১ জুলাই, সর্বপ্রথম এই দাবিটি তুলেছিল লুইসভিল বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর করে ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। মুনা হাফসা আপুর নেতৃত্বে তারা এই দাবিটি নিয়ে আসে এবং নজরুল ইসলাম সোহান ভাইয়ের সহযোগিতায় তারা একে একে এই দাবির পক্ষে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), মেশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি (এমএসইউ), পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সবগুলো ইউনিভার্সিটি থেকে এই দাবি আসতে থাকে। একপর্যায়ে দেখা যায়, ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে।
এছাড়াও স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স গ্রুপও শিক্ষার্থীদের ওপর এই ভয়াবহ হামলা বন্ধ এবং দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে; যার মধ্যে প্রথম দফা হলো- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ এবং সংসদকে বিলুপ্ত করা’।
শেষের দিনগুলো
আন্দোলনের শেষের দিনগুলো চরম উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতায় কাটে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে, কখন এই স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেশের মানুষকে মুক্তি দেবে। দিনরাত তারা অনলাইন বা টিভি সেটের সামনে বসে থাকে, প্রতীক্ষায় থাকে একটি সুখবরের, যে খবর তাদের সব প্রচেষ্টাকে সার্থক করবে।
৫ আগস্ট দিনগত রাত প্রায় ৪টার দিকে, যখন টিভি স্ক্রলে ভেসে ওঠে যে জাতির উদ্দেশে সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখবেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা করা হয় যে, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পালিয়ে গেছে, তখন আমাদের মনে এক অদ্ভুত আনন্দের ঝড় বয়ে যায়। জানি না সেই আনন্দ কীভাবে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। এটি ছিল এমন একটি মুহূর্ত; যা অবর্ণনীয়—আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেই সুখবর যেন এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
ভোর ৬টায় অনেকেই বাসার সামনে সবাই জড়ো হতে শুরু করেন, আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে অনেকেই বললেন, ‘চলো, সবাই মিলে বিজয় উদযাপন করি’। সেই মুহূর্তে আমরা সবাই যেন একসঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তির স্বাদ অনুভব করছিলাম। আমাদের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু এবং হৃদয়ে ছিল গর্বের অনুভূতি—যেন আমাদের সমস্ত ত্যাগ ও সংগ্রামের ফল আমরা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি।